যোগ সাজসে রাজশাহীতে পাঁচ বছরে বালু মহালে শতকোটি টাকা লুটপাট

যোগ সাজসে রাজশাহীতে পাঁচ বছরে বালু মহালে শতকোটি টাকা লুটপাট

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীতে বালু কারবারিদের সিন্ডিকেটের কারণে গত ৫ বছরে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তাতে যেন পুকুর চুরিকেও হার মানিয়েছে। রাজশাহী নগরীর আশেপাশে ১১টি ঘাট লিজ দিয়ে গত ৫ বছরে সরকারের কোষাগারে যে রাজস্ব জমা হয়েছে, তার ৫ গুন রাজস্ব আদায় হবে মাত্র এক বছরেই। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে সবমিলিয়ে যেখানে রাজস্ব আদায় হয়েছে বড় জোর তিন কোটি, সেখানে এবার আগামী মৌসুমের জন্য রাজস্ব আদায় হবে ১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা প্রায়।

অথচ গত ৫টি বছরে বালু সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজস করে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের একটি চক্র গোপনে লিজ প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে প্রায় শত কোটি টাকা রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিরও দাবি জানিয়েছেন রাজশাহীর বালু ব্যবসায়ীরা।

রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সূত্র মতে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে নগরীসহ জেলার গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট মিলে পদ্মা নদীর ১১টি ঘাট থেকে (বালুমহাল) বালু উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর বিপরীতে গত ৬ মার্চ বালুমহাল ইজারা প্রদানের দরপত্র বাক্স খুলে জমাকৃত দরপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়।

যাচাই-বাছাই শেষে আগামী ১৪২৫-২৬ মৌসুমের জন্য ১১টি বালুমহাল লিজ গ্রহণের জন্য ১৬ কোটি টাকারও ১৫ লাখ টাকা সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে লিজগ্রহণ করার জন্য দরপত্র জমা পড়ে। এর বাইরে ভ্যাট ও আয়করসহ সরকারের কোষাগারে জমা পড়বে প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো। লিজ প্রদানের বাকি কার্যক্রম চূড়ান্ত করার পক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই লিজ গ্রহণের জন্য দরপত্র জমাদানকারী ঠিকাদাররা এক বছরের জন্যই অন্তত এই ২০ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু গত ৫ বছরে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট ও আয়করসহ জমা পড়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন কোটি টাকা। তবে গত ৫ বছরে মোট কত টাকা জমা পড়েছে তা নিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে তথ্য না দেওয়ায় সেটি তুলে ধরা গেলেও সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি নয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জেলা প্রশাসকের দপ্তর সূত্র মতে, গত বছর রাজশাহীর পবার নবগঙ্গা-হাড়–পুর ঘাটটি লিজ দিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা পড়ে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর আগের কয়েক বছরেও একই হারে এই ঘাটটি লিজ দেওয়া হয়। ওই ঘাটটিই এবার লিজ গ্রহণের জন্য একই ব্যক্তি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি রজব আলী দর দিয়েছেন ৫ কোটি ২ লাখ টাকা। এর বাইরে যোগ হবে ভ্যাট ও আয়কর। সর্বোচ্চ দর প্রদানকারী হিসেবে রজব আলীকেই এবারো ঘাটটি দেওয়ার চূড়ান্ত কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এবারের দর হিসেবে গত ৫ বছরে এই ঘাটটি গোপনে লিজ প্রদান করে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

পবার মদনপুর, কসবা ও চরহরিপুর ঘাটটি গত বছর লিজ দিয়ে সরকারের ঘরে জমা পড়ে মাত্র ৫ লাখ ১৮ হাজার ১০০ টাকা। এর আগের কয়েক বছরেও একই হারে এই ঘাটটি লিজ দেওয়া হয়। কিন্তু এই ঘাটটি এবার আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি লিজ গ্রহণের জন্য দর দিয়েছেন ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই টাকার সঙ্গে যোগ হবে ভ্যাট ও আয়কর। কিন্তু গত বছর এই ঘাটটি ছিল রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক আজিজুল হক বেন্টুর নামে। গত প্রায় তিন বছর ধরে বেন্টুর আওতায় ছিল এই ঘাটটি। এই ঘাটটি গোপনে লিজ প্রদানের মাধ্যমে গত ৫ বছরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।

সূত্র মতে, পবার চর খিদিরপুর ও চর শ্যামপুর ঘাটটি গত বছর লিজ দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকায়। এর আগের কয়েক বছরেও একই হারে এই ঘাটটি লিজ দেওয়া হয়। কিন্তু এবার একই ব্যক্তি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক আজিজুল হক বেন্টু দর দিয়েছেন ২ কোটি ২ লাখ টাকা। ফলে গত এই ঘাটটিও গোপনে লিজ প্রদান করে সরকারের অন্তত ১০ কোটি টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। এছাড়া জেলার গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা মিলে রয়েছে আরো আটটি ঘাট। এই আটটি ঘাট মিলে এবার দর দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই আটটি ঘাট গত বছরে লিজ দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকায়। এর আগের কয়েক বছরেও গোপনে লিজ দিয়ে সমপরিমাণ টাকা আদায় করেছে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তর। ফলে গত ৫ বছরে এই আটটি ঘাট লিজ দিয়ে সরকারের ঘরে জমা পড়েছে বড় জোর ১ কোটি টাকা। সেই হিসেবে গত ৫ বছরে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।

এদিকে একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানা, গত বুধবার টেন্ডার ওপেনের দিন দরপত্র যাচাই-বাছাই চলাকালীন সময়ে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জেলা প্রশাসকের দপ্তরের টেন্ডার কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান, ‘গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে গত ৫ বছরে সরকারের মোট কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তবে টেন্ডার কমিটির সদস্যরা এ নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করার জন্য অনুরোধ করেন ওই জনপ্রতিনিধিদের।

কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে কাছে মুখ খোলেন। পাশাশি তারা গত ৫ বছরে গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারের যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান।

ওই সূত্রগুলো জানায়, বিগত বছরগুলোতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সহযোগিতায় রাজশাহীর বালুমহালের টেন্ডার গোপনে করা হত। ফলে অনেকেই জানতে পারতেন না। নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে দেওয়া হত নামমাত্র দরে। কিন্তু এবার রাজশাহীর কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও নতুন জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের শুরু থেকেই গোপনে বালুমহাল লিজ প্রদানে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। ফলে তাঁদের চেষ্টায় এবার প্রকাশ্যে টেন্ডার নোটিশ করে বালুমহালগুলো লিজ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। আর তাতেই ১১টি বালুমহাল লিজ নিতে ১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকার মতো দর দেন ঠিকাদাররা। অথচ গত ৫ বছরে সরকারের ঘরে জমা পড়েছে সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা।

এদিকে গত ৫ বছরে মোট কত টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে বালুমহাল থেকে তা জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এইভাবে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। তথ্য নিতে হলে আবেদন করতে হবে। আবেদন পেলে আমরা সেই অনুযায়ী তথ্য দিব।’

বালুমহাল টেন্ডার কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদেরের কাছে সরকারের এই রাজস্ব ফাঁকি সম্পকে জানতে চাইলে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি কোনো অনিয়ম হতে দেননি বলে দাবি করেন। যার ফলে এবার সরকারের কোষাগারে রাজশাহীর ১১টি বালুমহাল লিজ প্রদান করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব জমা হবে। সিল্ক সিটি।

মতিহার বার্তা ডট কম- ১৫ মার্চ ২০১৯

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply